জয়পুরঃ গোলাপী শহর
রাজস্থান ভ্রমণ শুরু করা যেতে পারে বিকানীর থেকে অথবা জয়পুর থেকে| তবে জয়পুর থেকে শুরু করার একটা ভালো দিক হল- মানিয়ে নিতে সুবিধে হয়| জয়পুর দিল্লির কাছাকাছি শহর তাই এর একটা cosmopolitan character আছে | এখানে এক-দুদিন থাকলে রাজস্থান ভ্রমনের জন্য আপনি মানসিক প্রস্তুতি পেয়ে যাবেন| রাজস্থানী খাবার, স্থাপত্য, যানবাহনের গতিপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরী হয়ে যাবে, অনেকটা swimming pool এ handle ধরে সাঁতার শেখার মত| বিকানীর তার রূপে রঙ্গে অনেক বেশি রাজস্থানী| হাবুডুবু খেয়ে, মাঝ দরিয়াতে সাঁতার শেখা যদি আপনার উদ্দেশ্য হয় তবে বিকানীর থেকেও শুরু করতেই পারেন | আর যাই হোক, এক্ষেত্রে ডুবে যাওয়ার ভয় তো নেই|
আমাদের দলে বিভিন্ন বয়সী লোকজন ছিল তাই আমরা একটু বুঝেশুনে রাজস্থান ভ্রমণের শুরুয়াত করেছি জয়পুর থেকে| জয়পুর এয়ারপোর্ট থেকে শহর জয়পুরে আসার পথে আমাদের পরিচয় হতে শুরু রাজস্থানের সঙ্গে| চওড়া রাস্তার ধারে চোখে পড়তে লাগল রাজস্থানি কারুকার্য করা বাড়ী, হোটেল , কলেজ | কখনো বা ছোট ছোট কেল্লা|
আমাদের হোটেল ছিল চিত্র কথা | এই বুটিক হোটেলের বাইরেটা দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে| নানা চিত্রে চিত্রিত চিত্র কথা |
এখানে ব্যালকনি থেকে একটা ফোর্ট দেখা যায়| দেখলে মনে হয় কোনো ভূতের গল্প বইতে আঁকা ভূতের মুখ দেখছি|
যন্তর মন্তরঃ
জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিং ১৭২৪ খ্রীঃ থেকে ১৭৩৫ খ্রীঃ এর মধ্যে মোট পাঁচটি যন্তর মন্তর তৈরী করেছিলেন-নতুন দিল্লী, জয়পুর, উজ্জ্বয়িনী, মথুরা,এবং বেনারসে| এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যন্তর মন্তরে পৌঁছে গেলাম আমরা গাইডের সঙ্গে|
এখানে মোট ১৯ টি astronomical instrument আছে| জ্যোতির্বিদ্যা যদি আপনার পাঠ্য বিষয় না হয় তাহলেও আপনার এখানে খুব ভালো লাগবে| বুঝতেই পারবেন না কতক্ষণ সময় কেটে গেছে এখানে | তার একটা বড় কারণ হল -গাইড এর বোঝানোর ক্ষমতা আর হাতে নাতে করার অভিজ্ঞতা|
জয় প্রকাশ যন্ত্রের সাহায্যে মাপা যায় স্থানীয় সময়, অক্ষাংশ,দ্রাঘিমাংশ আরো কত কি| এমন কি রাতে ও এই অর্ধ গোলক যন্ত্রটির ভিতরে প্রবেশ করে পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের কাজ করা যায়| এছাড়া ও রয়েছে রাম যন্ত্র, দিগাংশ যন্ত্র, বৃহৎ সম্রাট যন্ত্র ,রাশি যন্ত্র ইত্যাদি|
আর আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সূর্য ঘড়ি |
যদি অঙ্ক কষতে কষতে একঘেয়ে লাগে তবে রাশি যন্ত্রের কাছে বসে একটু জিরিয়ে নিন| হঠাৎ চোখে পড়ে যেতে পারে Damsel Crane। এর চলার ছন্দে তখন আপনার মনে বাজবে – ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ , করি অঙ্কে ভুল গো |
যন্তর মন্তর এর প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা (জন প্রতি)
জয়পুর সিটি প্যালেস
“রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর এর স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্য” এই কথাটা খুব বেশি করে মনে পড়ে সিটি প্যালেসে এলে| ভারতীয় ও মোঘল স্থাপত্য শিল্পের মেলবন্ধনে লাল ও গোলাপী বেলে পাথরে তৈরী এই প্যালেস বাঙালির মনে গর্বের সঞ্চার করবেই|
এখানে বিখ্যাত দুটি মহল- মুবারক মহল ও চন্দ্র মহল|
মুবারক মহল কে আমাদের গাইড টেক্সটাইল মহল বলেই পরিচয় করালো কারণ এখানে রাজ পরিবারের ব্যবহৃত কাশ্মীরি পশমিনা শাল, রেশম বস্ত্র, বিভিন্ন কারুকার্যখচিত পোষাক ইত্যাদি সংগৃহিত আছে| আর আছে সোয়াই প্রথম মাধো সিং এর পোষাক| এটি দেখলে অনেকেই বেশ কিছুদিনের জন্য ডায়েট চার্টকে পাত্তা না দেবার সাহস পেয়ে যাবেন| এই মহারাজা ছিলেন ৩.৯ ফুট চওড়া আর ২৫০ কেজি ছিল তাঁর ওজন| এর সঙ্গে বিনীত গাইড যোগ করলেন ,” ইনকা একশো আট বিবিয়াঁ থে” !!
অস্ত্র কক্ষে বা Armoury Mahal এ আছে রাজাদের ব্যবহৃত অস্ত্রসম্ভার| আর দেওয়ান-ই -আম অর্থাৎ আমজনতার দরবার এ সংরক্ষিত আছে দুটি বিশাল বড় রৌপ্য জলপা্ত্র , এদের ওজন ৩৪০ কেজি করে এবং ৪০০০লি জল এতে রাখা যায়| মহারাজা দ্বিতীয় মাধো সিং এডোয়ার্ড দ্য সেকেন্ড এর অভিষেকের উদ্দেশ্য ইংলন্ড যাবার সময় এই দুটি পাত্রে গঙ্গাজল নিয়ে গেছিলেন পান করার জন্য| ইংলন্ডের জল পান করে ধর্ম খোয়ানোর ইচ্ছে তাঁর ছিল না| তাই এই সামান্য ব্যবস্থা!এইসব দেখে মনে পড়ে যাবে Jim Corbett এর My India তে উল্লিখিত গঙ্গা জল নিয়ে রাজা মহারাজাদের নদী পারাপার এবং ছুতমার্গের কথা |
চন্দ্র মহলের বেশির ভাগ অংশেই বর্তমানে রাজপরিবার বসবাস করে| এর সাতটি তলার মধ্যে নীচের তলায় একটি মিউজিয়াম আছে| এই মহলে ঢুকতে গেলে ২০০০ টাকা প্রবেশ মূল্য| এখানে দুপুরে খাওয়ার জন্য ক্যাফেটরিয়া আছে|
এছাড়া এই প্যালেসে আছে মহারানী প্যালেস, ভাগগি খানা ( রাজ পরিবারের গাড়ির সংগ্রহশালা) ও গোবিন্দ মন্দির|
আপনি যদি মহারাজা এক্সপ্রেস বা প্যালেস অন হুইলসে করে রাজস্থান ভ্রমনে আসেন তবে এখানে আপনার জন্য থাকবে রাজকীয় অভ্যর্থনা| সুসজ্জিত উট, ঘোড়া, বাদ্য যন্ত্র আর কাচ্চি ঘোড়ি নাচ সহযোগে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে চন্দ্র মহলের দিকে| আর আমার মত দর্শকদের জন্য তৈরি হবে রাজকীয় পরিবেশ,” মেজাজটাই তো আসল রাজা|”
জয়পুর সিটি প্যালেস দেখে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারেন কোনো রাজস্থানী থালি সহযোগে| আমাদের ড্রাইভার দুর্গাজী রাজপুত| এত উপকারী ও দরদী ড্রাইভার আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি| আমরা রাজস্থানী লাঞ্চ করবো শুনে দুর্গাজী আমাদের নিয়ে গেল এক রাজস্থানী রেস্টোরান্টে | হরেকরকম পদ দিয়ে খেলাম রাজস্থানী থালি সঙ্গে লস্যি ( এরা বলে ছাস ) আর মশলা পাপড়|
শিল্পগ্রামঃ
এরপর গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে শিল্পগ্রামে| এখানে একাধিক শিল্পগ্রাম আছে| এগুলো মূলতঃ প্রাইভেট শপিং সেন্টার, এখানে নানা ধরনের রেজাই ( ১০০০টাকা -১৫০০০টাকা), বেড সীট, বেড কভার,বাঁধনী শাড়ি, সালোয়ার ইত্যাদি পাওয়া যায়| ভেজিটেবিল পেন্টিং হাতে করে দেখানোর ব্যবস্থাও আছে|
জয়পুর শহরের দুটো অংশ- পুরোনো জয়পুর পুরোটাই গোলাপী রঙের | নতুন অংশটা গোলাপী নয়|
জয়গড় দুর্গঃ
যদি হাতে কম সময় থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি রওনা হতে হবে জয়গড় দুর্গের দিকে| জল মহলকে ডান হাতে রেখে বাঁ দিকে আরাবল্লী পাহাড়ের উপরে ওঠার পথটি খুবই মনোরম| পাহাড়ের চূড়ায় আছে জয়গড় দুর্গ| জিপ, টেম্পো ট্রাভেলর এখনে উঠে যেতে পারে|
এখানে আছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত চাকাওলা কামান -জয়বান| এটি নাকি একবারই দাগা হয়েছিল ১০০ কেজি বারুদের গোলা দিয়ে আর তা ৩৫ কিমি দূর পর্যন্ত গিয়েছিল| তবে যারা কামান দেগেছিল তারা নাকি কালা হয়ে গিয়েছিল| পরে দুর্গের ভিতরে একটা জলাশয় খনন করা হয়, যাতে কামান চালানোর পরেই সৈন্যরা লাফিয়ে পরে বিকট আওয়াজের হাত থেকে বাঁচতে পারে| তবে তার আর দরকার হয় নি কারণ কামান আর কখনই চলেনি|
এখন কামানের ব্যারেলের ভিতরের বাসিন্দা এক কবুতর দম্পতি | যুদ্ধের যন্ত্রে শান্তির মন্ত্র –অবাক হতেই হবে |
পড়ন্ত বিকেলে জয়গড় দুর্গের প্রাকারে সোনালী রোদ পড়ে দুর্গের ঐতিহাসিক রূপকে উজ্বল করে তোলে| দূরে মান সাগর লেকের জলে পদ্ম ফুলের মত ফুটে আছে জল মহল| সব কিছু মিলিয়ে মনে হবে এই কিছুক্ষণ আগেই বুঝি রাজা ছিলেন তাঁর পার্ষদ সমেত, এই বুঝি রওনা হয়েছেন জলমহলের দিকে| ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে আছে এখানে|
এই ছিল আমাদের প্রথম দিনের রাজস্থান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা| জয়পুরে আমরা যেটুকু দেখিছি তাই এখানে বললাম| এখান থেকে টুকটাক উপহারসামগ্রী কিনতে হলে বাপু বাজার যাওয়া যায়| আর দরাদরির ব্যাপারে বাঙালি পাঠককে আমি মোটেও জ্ঞান দিয়ে চাই না|